যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি’র চলমান সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয় শীর্ষক কোনো মন্তব্য করেনি

গত ০৬ নভেম্বর নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেলের মন্তব্য দাবিতে বিএনপি’র চলমান সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয় শীর্ষক একটি তথ্য দেশের একাধিক গণমাধ্যমের খবরে প্রচার করা হয়। 

উক্ত দাবিটি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচারিত প্রতিবেদন দেখুন সময় টিভি, ইত্তেফাক (ফেসবুক), বায়ান্ন টিভি, বহুমাত্রিক, রিদ্মিক নিউজ, পদ্মা টাইমস, সিভি ভয়েস

একই দাবিতে গণমাধ্যমের ফেসবুক পেজসহ অন্যান্য পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএনপি’র চলমান সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয় শীর্ষক কোনো মন্তব্য করেননি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল বরং সময় টিভি’র সাংবাদিক কর্তৃক বিএনপি’র চলমান সংঘাতের জন্য দায়ী করে বেদান্ত প্যাটেলের কাছে এ বিষয়ে মতামত চাওয়া হলেও তিনি আলোচিত দাবি সংশ্লিষ্ট কোনো মন্তব্য করেননি। 

আমরা বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে গত ০৬ নভেম্বর U.S. Department of State এর ইউটিউব চ্যানেলে আলোচিত প্রেস ব্রিফিংয়ের পুরো ভিডিওটি খুঁজে পাওয়া যায়। ভিডিওর Description অংশে স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একই প্রেস ব্রিফিংয়ের পুরো ট্রান্সক্রিপ্টের লিংক রয়েছে। ট্রান্সক্রিপ্ট থেকে জানা যাচ্ছে, ওইদিনের প্রেস ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ বিষয়ে দুইবার আলোচনা হয়েছে। 

উক্ত তথ্যের সূত্র ধরে ভিডিওর ২৯ মিনিট ৩০ সেকেন্ড সময় থেকে বাংলাদেশ বিষয়ে প্রথম আলোচনা খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে একজন সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করতে শোনা যায়, “Thank you so much, Vedant. Nice to see you up here. The Bangladeshi people, they want a free and fair election. U.S.A., from this room, they declared the C-3 visa policy, and now ongoing vandalism and destruction of public properties by Bangladesh Nationalist Party activists on the pretext of exercising democratic rights in contributing to the – disrupt the peaceful political environment to upheld the next parliamentary election in Bangladesh. Will you ask nationalist party to stop the violence and participate the upcoming general election? And I have another one.” 

প্রশ্নটির বাংলা অনুবাদটি এমন, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, বেদান্ত। আপনাকে এখানে দেখে ভালো লাগলো। বাংলাদেশের জনগণ একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। ইউ.এস.এ’র এই কক্ষ থেকে, তারা C-3 ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে, এবং বাংলাদেশের পরবর্তী সংসদ নির্বাচনকে আটকে দিতে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশকে ব্যাহত করতে বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের কর্মীদের দ্বারা গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের অজুহাতে ভাংচুর এবং সরকারী সম্পত্তি ধ্বংস করা হচ্ছে। আপনি কি জাতীয়তাবাদী দলকে সহিংসতা বন্ধ করে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বলবেন? এবং আমার আরও একটি প্রশ্ন আছে।”

জবাবে বেদান্ত প্যাটেল বলছিলেন, “We continue to closely monitor the electoral environment in Bangladesh leading up to this January’s election, and we take any incidents of violence incredibly seriously. We are engaging and will continue to engage with the government, with opposition parties, with civil society, and other stakeholders to urge them to work together for the benefit of the Bangladeshi people.”

এটির বাংলা অনুবাদটি এমন, “এই মুহূর্তে আমাদের মূল লক্ষ্য হলো, জানুয়ারির ভোটগ্রহণ পর্যন্ত বাংলাদেশের নির্বাচনী পরিবেশের দিকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং সরকার, বিরোধীদলের নেতা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও অন্যান্য অংশীজনদের সঙ্গে প্রয়োজন অনুযায়ী যোগাযোগ স্থাপন করে সবাইকে একসঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণে কাজ করার আহ্বান জানানো।”

পরবর্তীতে উক্ত সাংবাদিক আরেকটি প্রশ্ন করার সুযোগ পান। তিনি জানতে চান, ” Thank you so much. And I’ll be – Peter Haas, the honorable ambassador, in a really difficult situation. Last week, when the nationalist party leaders, they brought an U.S. citizen to their head office on camera to declare that he is the adviser of President Biden and he has an everyday connection 10 to 15 times with President Biden. And then the – other party leaders, BNP leader, has been telling, calling Peter Haas an avatar, as a rescuer for the nationalist party. Will you categorically deny this claim from the nationalist party, please? Thank you.”

অর্থাৎ, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। মাননীয় রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সত্যিই একটি কঠিন পরিস্থিতিতে আছেন। গত সপ্তাহে, যখন জাতীয়তাবাদী দলের নেতারা একজন মার্কিন নাগরিককে তাদের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে আসে ঘোষণা করার জন্য যে তিনি প্রেসিডেন্ট বাইডেন উপদেষ্টা এবং বাইডেনের সাথে তার প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ বার যোগাযোগ রয়েছে। আর দলের আরেক নেতা, পিটার হাসকে অবতার বলছেন, দলের উদ্ধারকারী হিসেবে অভিহিত করছেন। আপনি কি স্পষ্টভাবে জাতীয়তাবাদী দলের এই দাবি অস্বীকার করবেন, দয়া করে? ধন্যবাদ।” 

এই প্রশ্নের জবাবে বেদান্ত প্যাটেল বলেন, “I’ve not seen that report. And I’m going to be honest – I really have no idea what you’re talking about. So let me just say this.”

অর্থাৎ, “আমি সেই রিপোর্ট দেখিনি। এবং আপনি কি সম্পর্কে কথা বলছেন তা আমার সত্যিই কোন ধারণা নেই। তাই আমাকে শুধু এই বলতে দিন…”

প্যাটেলকে বলতে দেখা যায়, “Please don’t interrupt me. We have an incredibly talented team at our embassy in Dhaka, led by an experienced ambassador who is well-versed not just working in Bangladesh, but also the broader region largely. And as I have said, we are closely monitoring their electoral environment in Bangladesh, leading up to January’s election.”

এটির বাংলা অনুবাদটি এমন, “দয়া করে আমাকে বাধা দেবেন না। ঢাকায় আমাদের দূতাবাসে আমাদের একটি অবিশ্বাস্যভাবে প্রতিভাবান দল রয়েছে, যার নেতৃত্বে একজন অভিজ্ঞ রাষ্ট্রদূত যিনি শুধু বাংলাদেশেই নয়, বৃহত্তর অঞ্চলেও কাজ করতে পারদর্শী। এবং আমি যেমন বলেছি, আমরা জানুয়ারির নির্বাচন পর্যন্ত বাংলাদেশে তাদের নির্বাচনী পরিবেশ ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।”

অর্থাৎ, সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক নিজেই চলমান সংঘাতের জন্য বিএনপিকে দায়ী করে পুরো বিষয়টি বেদান্ত প্যাটেলের কাছে উপস্থাপন করে তার মন্তব্য জানতে চেয়েছেন। কিন্তু বেদান্ত তার বক্তব্যে বিএনপিকে চলমান সহিংসতার জন্য দায়ী করে এই সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয় শীর্ষক কোনো মন্তব্য করেননি। বরং তিনি বাংলাদেশের নির্বাচনী পরিবেশের দিকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করার কথা বলেছেন। 

আমরা অনুসন্ধানে জানতে পেরেছি, প্রশ্নকারী সাংবাদিকের নাম দস্তগীর জাহাঙ্গীর। তিনি সময় টিভি’র যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি। তিনি নিজেও প্রেস ব্রিফিংয়ে তার করা প্রশ্নের অংশটি ফেসবুকে শেয়ার করেছেন। 

প্রেস ব্রিফিংয়ের ৪৬ মিনিট সময় থেকে আরেকজন সাংবাদিককে বাংলাদেশ বিষয়ে প্রশ্ন করতে দেখা যায়। তার প্রশ্নটি ছিল, “Thank you, Vedant. Countrywide protests going on in Bangladesh. They’re demanding the resignation of the ruling prime minister, and the regime is in a sense declare war against the main opposition, BNP and protestors. Over 8,000 people have been detained, including BNP secretary general and all rank and file. At least 11 people killed since protests began on October 28. Ruling Prime Minister Hasina instructed her party members to throw opposition party members into fire or burn their hands. As the United States and the international community in Bangladesh are committed to creating a peaceful and credible environment for upcoming elections, for creating that environment, will you be with the people of Bangladesh and reflect their will under a new caretaker government?”

এটির বাংলা অনুবাদটি এমন, “ধন্যবাদ, বেদান্ত। সারা বাংলাদেশে বিক্ষোভ চলছে। তারা ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছে এবং সরকার এক অর্থে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছে। আটক করা হয়েছে, বিএনপি মহাসচিবসহ সব মিলিয়ে ৮ হাজারের বেশি লোককে। ২৮ অক্টোবর থেকে বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর অন্তত ১১ জন নিহত হয়েছেন। ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা তার দলের সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছেন বিরোধী দলের সদস্যদের আগুনে নিক্ষেপ করতে বা তাদের হাত পোড়াতে। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আসন্ন নির্বাচনের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সেই পরিবেশ তৈরির জন্য, আপনি কি বাংলাদেশের জনগণের পাশে থাকবেন এবং একটি নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাবেন?”

প্যাটেল উত্তরে বললেন, “So it’s important to remember – and you’ve heard me say this a number of times before, including in answering your friend’s question – that the U.S. does not support any political party in Bangladesh. We don’t favor any one political party over the other. Right now our focus continues to be closely monitoring the electoral environment in Bangladesh leading up to January’s election, engaging appropriately with the government, with opposition leaders, with civil society and other stakeholders to urge them to work together for the benefit of the Bangladeshi people.” 

এটির বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, “এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ – এবং আপনি আমাকে অনেকবার এটা বলতে শুনেছেন, আপনার বন্ধুর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহ – যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে না। আমরা কোনো একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষপাত করি না। এই মুহূর্তে আমাদের দৃষ্টি জানুয়ারির নির্বাচন পর্যন্ত বাংলাদেশে নির্বাচনী পরিবেশ ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা, সরকারের সাথে, বিরোধী দলের নেতাদের সাথে, সুশীল সমাজ এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের সাথে বাংলাদেশি জনগণের সুবিধার জন্য একসাথে কাজ করার আহ্বান জানাতে যথাযথভাবে জড়িত হওয়া অব্যাহত রয়েছে।”

অর্থাৎ, এই সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরেও বেদান্ত প্যাটেল বিএনপিকে চলমান সহিংসতার জন্য দায়ী করে এই সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয় শীর্ষক কোনো মন্তব্য করেননি।

বেদান্তকে প্রশ্নকারী এই সাংবাদিকের নাম মুশফিক ফজল আনসারী, যিনি খালেদা জিয়ার সাবেক প্রেস সচিব। তিনিও তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তার করা প্রশ্নের অংশটি শেয়ার করেছেন।  

মূলত, গত ০৬ নভেম্বর নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এসে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল বিএনপি’র চলমান সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয় শীর্ষক একটি মন্তব্য করেছেন দাবিতে দেশের একাধিক গণমাধ্যমের খবরে প্রচার করা হয়। কিন্তু রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বেদান্ত প্যাটেল বিএনপি প্রসঙ্গে সেদিন এমন কোনো মন্তব্য করেননি। বাংলাদেশি একজন সাংবাদিক নিজেই চলমান সংঘাতের জন্য বিএনপিকে দায়ী করে পুরো বিষয়টি বেদান্ত প্যাটেলের কাছে উপস্থাপন করে তার মন্তব্য জানতে চেয়েছিলেন। জবাবে বেদান্ত জানান,  “যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের যে কোন সহিংসতার ঘটনা গুরুত্বের সাথে নিচ্ছে।” কিন্তু বাংলাদেশ বিষয়ক সেদিনের প্রেস ব্রিফিংয়ের আলোচনাগুলো বিশ্লেষণ করে বেদান্ত প্যাটেল “বিএনপি’র চলমান সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয়” শীর্ষক মন্তব্য করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি।  

উল্লেখ্য, ঢাকায় গত ২৮ অক্টোবরের রাজনৈতিক সমাবেশ ঘিরে সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের এক বিবৃতিতে বলা হয়, 

২৮শে অক্টোবর ঢাকায় যে রাজনৈতিক সহিংসতা সংঘটিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র তার নিন্দা জানায়। একজন পুলিশ কর্মকর্তা, একজন রাজনৈতিক কর্মীহত্যা এবং একটি হাসপাতাল পোড়ানোর ঘটনা অগ্রহণযোগ্য। সাংবাদিকসহ বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতাও তেমনই। আমরা সব পক্ষকে শান্তি ও সংযমের আহ্বান জানাই। সম্ভাব্য ভিসা নিষেধাজ্ঞার জন্য আমরা সমস্ত সহিংস ঘটনার পর্যালোচনা করব।

সুতরাং, গত ০৬ নভেম্বরের প্রেস ব্রিফিংয়ে এসে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল বিএনপি’র চলমান সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয় শীর্ষক একটি মন্তব্য করেছেন দাবিতে দেশের একাধিক গণমাধ্যমের খবরে প্রচার করা হয়; যা বিভ্রান্তিকর। 

তথ্যসূত্র 

আরও পড়ুন

spot_img