যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে ফিলিস্তিনে গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরায়েল যার দরুণ ফিলিস্তিনে মানবিকতার চরম সংকট দেখা দিয়েছে। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের এমন আগ্রাসনের প্রতিবাদ বিশ্বের নানা দেশ থেকে আসছে।৷ বাংলাদেশেও নিয়মিতভাবে ইসরায়েলের এমন আগ্রাসনের প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। এদিকে ইসরায়েলের এমন আগ্রাসনে সৌদি আরব সরকার নীরব ভূমিকা পালন করছে দাবি করে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ছবি নানাভাবে কটাক্ষ করা হয়েছে বাংলাদেশে। এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাবি প্রচার করা হয়েছে, “৮ হাজার প্রবাসী’কে ফেরত পাঠালো সৌদি আরব। এবার সৌদি বাদশার ছবিতে আরো জুতা মার বেশি করে!”
অর্থাৎ, সৌদি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গকে এরূপ কটাক্ষের কারণেই সৌদি আরবে থাকা ৮ হাজার বাংলাদেশি প্রবাসীকে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। এছাড়াও এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে জড়িয়ে “ইউনুসের কুটনৈতিক ব্যর্থতার কারণে ৮ হাজার প্রবাসী ফেরত পাঠালো সৌদি আরব” শীর্ষক দাবিও প্রচার করা হয়েছে।
এরূপ দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

এরূপ দাবিতে এক্সে (সাবেক টুইটার) প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সম্প্রতি সৌদি আরবের ফেরত পাঠানো ৮ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক ছিলেন শীর্ষক দাবিটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে ফেরত পাঠানো প্রবাসীদের নাগরিকত্ব সৌদি আরব বা আলোচিত দাবিতে প্রচারিত পোস্টে উল্লিখিত তথ্যসূত্রতেও উল্লেখ করা হয়নি। অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে সৌদিতে প্রবেশের চেষ্টা করার সময় গ্রেপ্তার হওয়া ১ হাজার ৪৯৭ জনের নাগরিকত্ব উল্লেখ করা হয়েছে যার মধ্যে ৬৯ শতাংশ ইথিওপিয়ান, ২৭ শতাংশ ইয়েমেনি এবং চার শতাংশ অন্যান্য দেশের নাগরিক রয়েছেন বলে জানানো হয়েছে। তাছাড়া, ফেরত পাঠানো এসব প্রবাসীদের সাথে বাংলাদেশে মোহাম্মদ বিন সালমানকে কটাক্ষ করার কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি বরং আইন ভঙ্গ করার কারণে তাদেরকে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত নানা পোস্টে দাবিটির সপক্ষে তথ্যপ্রমাণ হিসেবে অনলাইন সংবাদমাধ্যম জাগোনিউজ২৪ এর ওয়েবসাইটে “৮ হাজার প্রবাসীকে ফেরত পাঠালো সৌদি আরব” শীর্ষক শিরোনামে গত ১৩ এপ্রিলে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনকে উল্লেখ করতে দেখা যায়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, “সৌদি আরব আবাসন, শ্রম ও সীমান্ত আইন লঙ্ঘনের জন্য ১৮ হাজার ৬০০ জনেরও বেশি ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। গত এক সপ্তাহে অভিযান চালিয়ে তাদেরকে ধরা হয়। শনিবার (১২ এপ্রিল) সৌদির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে।
২০২৫ সালের হজ মৌসুমের আগে দেশটি সীমান্ত ও শ্রমশক্তির ওপর নজরদারি জোরদার করেছে। এর অংশ হিসেবেই এই অভিযান শুরু হয়েছে। গাল্ফ নিজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩ থেকে ৯ এপ্রিলের মধ্যে একাধিক সরকারি সংস্থা অভিযানের চালিয়ে ১৮ হাজার ৬৬৯ জন জনকে গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে ১১ হাজার ৮১৩ জনকে ধরা হয়েছে আবাসিক আইন লঙ্ঘনের জন্য। ৪ হাজার ৩৬৬ জনকে সীমান্ত নিরাপত্তা আইন ও ২ হাজার ৪৯০ জনকে শ্রম আইন লঙ্ঘনের জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে। তাছাড়া এক হাজার ৪৯৭ জনকে ধরা হয়েছে অবৈধভাবে সৌদি আরবের প্রবেশের চেষ্টা করার সময়।
মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই ব্যক্তিদের মধ্যে ৬৯ শতাংশ ইথিওপিয়ার নাগরিক, ২৭ শতাংশ ইয়েমেনি ও বাকি চার শতাংশ অন্যান্য দেশের নাগরিক। কর্তৃপক্ষ অবৈধভাবে সৌদি ত্যাগ করার চেষ্টা করায় ৫৯ জনকে আটক করেছে। তাছাড়া ২৫ হাজার ৭৫৪ জন ব্যক্তিকে ভ্রমণের নথিপত্রের জন্য তাদের নিজ নিজ কূটনৈতিক মিশনে পাঠানো হয়েছে। আরও ২ হাজার ২৭৯ জন আইন লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন। একই সঙ্গে ৮ হাজার ১২৬ জনকে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।… ” উক্ত প্রতিবেদনটিতে তথ্যসূত্র হিসেবে গাল্ফ নিউজ’কে উল্লেখ করা হয়েছে।
পরবর্তীতে এরই সূত্র ধরে অনুসন্ধান করলে গাল্ফ নিউজের ওয়েবসাইটে “Saudi Arabia deports 8,000 illegal residents ahead of Hajj” শীর্ষক শিরোনামে এ বিষয়ে গত ১৩ এপ্রিলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হতে দেখা যায়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, “সৌদি আরবে এক সপ্তাহব্যাপী বিশেষ অভিযানে ১৮,৬০০-র বেশি ব্যক্তিকে আবাসন, শ্রম এবং সীমান্ত নিরাপত্তা আইন লঙ্ঘনের দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে শনিবার [১২ এপ্রিল] সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা করেছে।… ১,৪৯৭ জনকে সৌদি আরবে অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টা করার সময় আটক করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গ্রেপ্তার হওয়া এসব ব্যক্তিদের মধ্যে ৬৯ শতাংশ ইথিওপিয়ার নাগরিক, ২৭ শতাংশ ইয়েমেনি এবং বাকি ৪ শতাংশ অন্যান্য দেশের। এছাড়া, অবৈধভাবে সৌদি আরব ছাড়ার চেষ্টা করার সময় আরও ৫৯ জনকে আটক করা হয়েছে। অভিযানটি অভিবাসন ও শ্রম আইন বাস্তবায়নের চলমান প্রচেষ্টার অংশ। এর ফলে ২৫,৭৫৪ জনকে নিজ নিজ দেশের কূটনৈতিক মিশনে পাঠানো হয়েছে ভ্রমণের কাগজপত্রের জন্য। আরও ২,২৭৯ জনের ভ্রমণের ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন, এবং ৮,১২৬ জনকে সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।” (অনূদিত) এছাড়াও, প্রতিবেদনটিতে অপরাধভেদে পরিসংখ্যানেরও উল্লেখ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে সৌদি আরবের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভেরিফাইড এক্স অ্যাকাউন্ট পর্যবেক্ষণ করলে গত ১২ এপ্রিলে এ বিষয়ে প্রকাশিত একটি পোস্ট পাওয়া যায়। পোস্টে উল্লিখিত তথ্যগুলো জানা যায়। তবে, উপরোল্লিখিত কোনো প্রতিবেদন বা সৌদি সরকারের পোস্টেও দেশে ফেরত পাঠানো ৮১২৬ জনের দেশের নাম আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি আলোচিত দাবিতে প্রচারিত পোস্টগুলোতে তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লিখিত প্রতিবেদনেও দেশে ফেরত পাঠানো প্রবাসীরা বাংলাদেশের নাগরিক মর্মে কোনো উল্লেখ করা হয়নি।
অর্থাৎ, সম্প্রতি নানা অপরাধে ১৮ হাজারেরও অধিক ব্যক্তিকে সৌদি আরব আটক করেছে। ১,৪৯৭ জনকে সৌদি আরবে অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টা করার সময় আটক করা হয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ৬৯ ভাগ ইথিওপিয়ান, ২৭ ভাগ ইয়েমেনি এবং বাকী ৪ শতাংশ অন্যান্য নানা দেশের। তাছাড়া, প্রায় ৮ হাজার ব্যক্তিকে সৌদি আরব থেকে ফেরত পাঠিয়েছে। তবে, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত পোস্টে তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লিখিত জাগোনিউজে প্রকাশিত প্রতিবেদন বা জাগোনিউজের সূত্র গাল্ফ নিউজের প্রতিবেদন বা সৌদি আরবের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পোস্টের কোনোটিতেই দেশে ফেরত পাঠানো ৮ হাজার প্রবাসীকে বাংলাদেশি হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে, দেশে ফেরত পাঠানো ব্যক্তিদের নাগরিকত্বই আলাদাভাবে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। কেবলমাত্র সৌদি আরবে অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টা করার সময় আটক হওয়া ১,৪৯৭ জনের নাগরিকত্ব উল্লেখ করা হয়েছে যার মধ্যে প্রায় ৯৬ শতাংশই ইথিওপিয়া ও ইয়েমেনের নাগরিক। অর্থাৎ, ফেরত পাঠানো ৮ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি এরূপ দাবির সপক্ষে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ নেই।
সুতরাং, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বা সৌদি সরকারের ব্যক্তিবর্গকে কটাক্ষ করার কারণে বা ইউনূস সরকারের কূটনীতিক ব্যর্থতার কারণে সম্প্রতি ৮ হাজার বাংলাদেশি প্রবাসীকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে শীর্ষক দাবিটি বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- Jagonews24 – ৮ হাজার প্রবাসীকে ফেরত পাঠালো সৌদি আরব
- Gulf News – Saudi Arabia deports 8,000 illegal residents ahead of Hajj
- MOI Saudi Arabia – X Post