একমাত্র মেসিই কি একা “এডুকেশন ফর অল” আর্ম ব্যান্ড পরেছেন?

সম্প্রতি “পৃথিবীর অন্য লিডার,ক্যাপটেনরা যখন সমকামিতার ওয়ান লাভ আর্মব্যান্ড ও রংধনু কালার নিয়ে ব্যস্ত,ঠিক তখন গ্রহের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের হাতের আর্মব্যান্ড এডুকেশনের মেসেজ দিয়ে যাচ্ছে,হা তিনিই আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি দলীয় অধিনায়ক বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ফুটবল মহাতারকা ক্যাপ্টেন মেসি” শীর্ষক শিরোনামে একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে৷ 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, অন্যান্য দেশের ফুটবল দলের অধিনায়কদের ওয়ান লাভ আর্ম ব্যান্ড দিয়ে ব্যস্ত থাকার বিপরীতে মেসি আর্ম ব্যান্ডের মাধ্যমে শিক্ষার বার্তা দেওয়ার তথ্যটি সঠিক নয় বরং বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী দলের অধিনায়কের জন্য ফিফা কর্তৃক সরবরাহকৃত আর্ম ব্যান্ড পরার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

বিশ্বকাপে অধিনায়কদের ওয়ান লাভ আর্ম ব্যান্ড পরার সুযোগ আছে কি?

কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার ওয়েবসাইটে অধিনায়কদের আর্ম ব্যান্ড কেমন হবে এ সংক্রান্ত একটি Equipment Regulations নামে একটি আইন খুঁজে পাওয়া যায়।

আইনটির ১৩.৮.১ ধারায় বলা হয়েছে,  ফিফা কর্তৃক আয়োজিত টুর্নামেন্টে দলগুলোর অধিনায়কদের ফিফা কর্তৃক সরবরাহকৃত আর্মব্যান্ডই পরিধান করতে হবে৷ অপরদিকে আইনটির ১৩.৮.২ এ বলা হয়েছে, ফিফার আয়োজন ছাড়া অন্যান্য প্রতিযোগিতা ও আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচগুলোতে অধিনায়কেরা তাদের দলের আর্ম ব্যান্ড পরতে পারবেন। 

অপরদিকে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স ২৪ নভেম্বর “World Cup 2022: what is the OneLove armband and why did FIFA ban it?” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ফিফার আইনকে উদ্ধৃত করে জানায়, ফিফা আয়োজিত টুর্নামেন্টে দলগুলোর ব্যবহৃত কোনো উপকরণে কোনো রাজনৈতিক, ধর্মীয় অথবা ব্যক্তিগত স্লোগান, বিবৃতি বা ছবি ব্যবহার করা যাবে না৷

এই আইন দুইটি অনুযায়ী, বিশ্বকাপ চলাকালীন অংশগ্রহণকারী দলগুলোর আর্মব্যান্ড কেমন হবে তা নিয়ে ফিফার নিয়ম অনুযায়ী বাধ্যবাধকতা রয়েছে৷

এছাড়া একই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইংল্যান্ড, ওয়েলস, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি ও ডেনমার্ক কাতারের সমকামী বিরোধী আইনের বিরোধিতা করে ওয়ান লাভ আর্মব্যান্ড বা বাহুবন্ধনী পরার পরিকল্পনা করেছিল। তবে দলগুলোর এমন পরিকল্পনায় ফিফা সিদ্ধান্ত নেয় যে, কেউ এমন আর্মব্যান্ড পরিধান করলে তাকে হলুদ কার্ড দেখানো হবে৷

অর্থাৎ বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর ফিফা কর্তৃক যেসব আর্ম ব্যান্ড সরবরাহ করা হয়েছে তার বাইরে ভিন্ন কোনো আর্ম ব্যান্ড তথা ওয়ান লাভ আর্ম ব্যান্ড পরারই সুযোগ নেই।

আর্জেন্টিনার অধিনায়ক মেসির “এডুকেশন ফর অল” আর্ম ব্যান্ড কিভাবে এলো?

যেহেতু ফিফা কর্তৃক আয়োজিত টুর্নামেন্টে দলগুলোর অধিনায়কদের ফিফা কর্তৃক সরবরাহকৃত আর্ম ব্যান্ডই পরিধান করতে হয়, তাই চলতি বিশ্বকাপে ফিফার আর্ম ব্যান্ডগুলো কেমন তা অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিশ্বকাপের প্রতিটি পর্বের খেলার জন্য ফিফা আলাদা আলাদা আর্ম ব্যান্ড নির্ধারিত করেছে। 

এই সম্পর্কিত তথ্য অনুসন্ধানে ফিফার ওয়েবসাইটে চলতি বছরের ১৯ নভেম্বর “FIFA partner with United Nations agencies to run social campaigns during World Cup” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কাতার বিশ্বকাপের প্রতিটি পর্বের ম্যাচে আলাদা আলাদাভাবে ক্যাম্পেইন চালাবে ফিফা৷ 

এ উদ্দেশ্যে ফিফা ইউনেস্কো, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে একতাবদ্ধ হয়েছে৷ ফিফার এসব ক্যাম্পেইনের মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য, ঐক্য ও বৈষম্যহীন বিশ্ব গড়ে তোলা। এই সংক্রান্ত বার্তাগুলো প্রচার করা হবে, অংশগ্রহণকারী দলগুলোর অধিনায়কের আর্ম ব্যান্ড, মাঠের চারপাশের এলইডি স্ক্রিন, বড় পর্দা ও স্টেডিয়ামে পতাকা সহ বিভিন্ন উপায়ে।

পুরো বিশ্বকাপ জুড়ে ফিফা পরিচালিত ক্যাম্পেইনগুলো নিম্নরূপ:

পুরো বিশ্বকাপ জুড়ে ক্যাম্পেইনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বৈষম্যহীন বিশ্ব গড়ে তোলা।

এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচগুলোতে ক্যাম্পেইনের প্রতিপাদ্য ছিল Football Unites the World। গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচগুলোতে ক্যাম্পেইনের প্রতিপাদ্য ছিল Save the Planet। গ্রুপ পর্বের তৃতীয় ম্যাচগুলোতে ক্যাম্পেইনের প্রতিপাদ্য ছিল Protect Children, End Hunger।

এরপর নক আউট পর্বের রাউন্ড অব ১৬ এর ম্যাচগুলোতে ক্যাম্পেইনের প্রতিপাদ্য ছিল Education for All। কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচগুলোতে ক্যাম্পেইনের প্রতিপাদ্য No Discrimination। সেমি ফাইনালের ম্যাচগুলোতে ক্যাম্পেইনের প্রতিপাদ্য Be Active। তৃতীয় স্থান ও ফাইনালের ম্যাচের জন্য ক্যাম্পেইনের প্রতিপাদ্য হলো Football Unites the World।

অর্থাৎ বিশ্বকাপের প্রতিটি পর্বের জন্য ফিফা কর্তৃক আলাদা আলাদা ক্যাম্পেইন লক্ষ্য ঠিক করে রেখেছে কর্তৃপক্ষ।

এরই সুবাদে রাউন্ড অব ১৬ এর আর্জেন্টিনা বনাম অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচে মেসির হাতের আর্ম ব্যান্ডে Education for All লেখা দেখতে পাওয়া যায়। তবে কেবল মেসিই নয়, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে শেষ ১৬ এর ম্যাচে ব্রাজিলের অধিনায়ক থিয়াগো সিলভার হাতের আর্ম ব্যান্ডেও একই লেখা দেখা যায়। 

একইভাবে শেষ ১৬ এর খেলায় ইংল্যান্ডের সাথে সেনেগালের ম্যাচে সেনেগালের অধিনায়কের আর্ম ব্যান্ডেও একই খেলা সম্বলিত ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। 

অর্থাৎ মেসির হাতে “এডুকেশন ফর অল” লেখা যে আর্ম ব্যান্ড তা মেসি স্বেচ্ছায় বেছে নেননি। বরং বিশ্বকাপকে ঘিরে ফিফার আয়োজিত ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবেই এটি তাকে পরতে হয়েছে। এছাড়া কেবল মেসিই নয়, এই পর্বে উঠা প্রত্যেক ম্যাচের অধিনায়ককেই এই আর্ম ব্যান্ড পরতে হয়েছে।

অপরদিকে অনুসন্ধানে মেসিকেও ক্লাব পর্যায়ের খেলায় সতীর্থদের সঙ্গে সমকামিতা সম্পর্কিত প্রচারণার অংশ হিসেবে রেইনবো বা রঙধনু রঙের নাম্বার বিশিষ্ট জার্সি পরতে দেখা যায়। 

চলতি বছরের ২২ মে মেসির বর্তমান ক্লাব পিএসজি রেইনবো বা রঙধনু রঙের নাম্বার বিশিষ্ট জার্সি পরে খেলতে নেমেছিল।

এর আগে পিএসজি তাদের ভ্যারিফাইড টুইটার একাউন্টে চলতি বছরের ১৪ মে একটি টুইট বার্তায় জানায়, আন্তর্জাতিক সমকামিতা ভীতি প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে ক্লাবটির জার্সিগুলোতে থাকবে রঙধনু পতাকা, যা এলজিবিটি আন্দোলনের বৈচিত্র্য ও শান্তির প্রতীক। সেখানে মেসিও তার অন্যান্য সতীর্থদের সঙ্গে রেইনবো বা রঙধনু রঙের নাম্বার বিশিষ্ট জার্সি পরে খেলতে নেমেছিলেন।  

অর্থাৎ, মেসি রেইনবো বা সমকামিতা সম্পর্কিত প্রচারণাকে অগ্রাহ্য করেন ব্যাপারটি তেমন নয়, বরং ক্লাব বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিয়ম মেনে তিনিও এই সম্পর্কিত প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন।

মূলত, কাতারে চলমান বিশ্বকাপকে ঘিরে ফিফা বৈষম্যহীন বিশ্ব গড়ে তুলতে প্রতিটি পর্বের ম্যাচে আলাদা আলাদাভাবে প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এই প্রচারণার অংশ হিসেবেই আর্জেন্টিনার অধিনায়ক মেসিকে অন্যান্য দলের অধিনায়কদের মতোই “Education for All” শীর্ষক আর্ম ব্যান্ড পরে খেলতে নামতে দেখা যায়। এছাড়া অনুসন্ধানে দেখা যায়, ফিফা কর্তৃক আয়োজিত টুর্নামেন্টগুলোতে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর অধিনায়কদের আর্মব্যান্ড কেমন হবে তা নিয়ে ফিফার নির্দিষ্ট আইন রয়েছে৷ এর বাইরে কোনো অধিনায়ক আর্মব্যান্ড পরিধান করলে তাকে হলুদ কার্ড দেখানো হবে চলমান কাতার বিশ্বকাপে সিদ্ধান্ত নেয় ফিফা৷ তাই বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর অধিনায়ককেই ফিফা কর্তৃক সরবরাহকৃত আর্ম ব্যান্ড পরতে দেখা যায়। তবে ফিফা কর্তৃক আয়োজিত টুর্নামেন্টের বাইরে ক্লাব ফুটবলে মেসিকে রেইনবো বা রঙধনু রঙের নাম্বার বিশিষ্ট জার্সি পরে খেলতে নেমেছিলেন। 

প্রসঙ্গত, ওয়ান লাভ আর্মব্যান্ড কর্মসূচিটি প্রথম চালু হয় ২০২০ সালে নেদারল্যান্ডসের রয়েল ডাচ ফুটবল এসোসিয়েশনের উদ্যোগে। এই উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছিল মূলত, বর্ণ, গায়ের রঙ, যৌন বৈচিত্রতা, সংস্কৃতি, বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, জেন্ডার, বয়স সহ সকল ধরনের বৈষম্যের বিরোধিতা করে।

সুতরাং, অন্যান্য দেশের ফুটবল দলের অধিনায়কদের ওয়ান লাভ আর্ম ব্যান্ড দিয়ে ব্যস্ত থাকার বিপরীতে মেসি আর্ম ব্যান্ডের মাধ্যমে শিক্ষার বার্তা দেওয়ার তথ্যটি সঠিক নয়; এটি সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর।

আরও পড়ুন

spot_img