ড. ইউনূসের জাতিসংঘের ভাষণ বাতিলের গুজব

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতা হারায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। ০৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপর শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে অনেকেই নানারকম তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে। ০৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগ পরবর্তী এক ব্রিফিংয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) পদত্যাগ করেছেন। এখন একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে আমরা আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবো।’ ঐদিন রাতেই জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ (০৫ আগস্ট) রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি।’ তবে শেখ হাসিনার দাবি, সংবিধান অনুযায়ী তিনি এখনো দেশের ‘বৈধ প্রধানমন্ত্রী’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি কথিত ফোনালাপে এমন দাবি করতে দেখা যায় তাকে। তার দাবি, দেশ ছাড়ার আগে তিনি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে গণভবন থেকে বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিতে পারেননি। এর আগে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় দাবি করেছেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি। সংবিধান অনুযায়ী তিনি এখনো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এদিকে চলতি সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ৭৯তম সাধারণ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দাবি প্রচার করা হচ্ছে, “শেখ হাসিনা জাতিসংঘে যাবার নিমন্ত্রণ পেয়েছে,,, শেখ হাসিনা এখনো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী,,, ড, ইউনুসের জাতিসংঘে ভাষণ বাতিল ঘোষণা।”

ড. ইউনূসের জাতিসংঘের ভাষণ

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, শেখ হাসিনা জাতিসংঘে যাবার নিমন্ত্রণ পাননি এবং ড. ইউনূসের জাতিসংঘের ভাষণও বাতিল ঘোষণা করা হয়নি বরং কোনোরকম নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই আলোচিত দাবিগুলো প্রচার করা হচ্ছে। 

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত পোস্টগুলো পর্যবেক্ষণ করলে আলোচিত দাবির সপক্ষে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ উল্লেখ করতে দেখা যায়নি।

উল্লেখ্য, চলতি সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ৭৯তম সাধারণ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

আলোচিত দাবির বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে প্রচারিত দাবিটির সপক্ষে কোনো বিশ্বস্ত তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। জাতিসংঘে শেখ হাসিনার যাওয়ার বিষয়ে সর্বশেষ গত বছরে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন পাওয়া গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে নির্ভরযোগ্য সূত্রে বা গণমাধ্যমে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ হতে দেখা যায়নি।

জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে শেখ হাসিনার যোগদান দেওয়া সম্পর্কে সর্বশেষ ২০২৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখে মূলধারার সংবাদমাধ্যম দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জাতিসংঘের ৭৮ তম সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে ২০২৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখে দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের চলমান ৭৯তম সাধারণ অধিবেশনে শেখ হাসিনার যোগ দেওয়ার বিষয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোন তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।

তাছাড়া, জাতিসংঘে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণ বাতিলের বিষয়েও প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং মূলধারার গণমাধ্যম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের গত ৬ সেপ্টেম্বর তারিখের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চলতি মাসে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দিতে সাত সদস্যবিশিষ্ট দল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। 

তবে, আলোচিত দাবিটি ১০ সেপ্টেম্বর তারিখে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়৷ তাই, এর পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ের সংবাদ অনুসন্ধান করলে সংবাদমাধ্যম আজকের পত্রিকায় গত ১৮ সেপ্টেম্বর “জাতিসংঘ অধিবেশন: ২৭ সেপ্টেম্বর ভাষণ দেবেন ড. ইউনূস” শিরোনামে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটি পড়ে জানা যায়, ড. ইউনূস বাংলাদেশের সরকারপ্রধান পরিচয়ে জাতিসংঘে যাচ্ছেন। এই পরিচয়ে তিনি বিশ্ব সংস্থাটির সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেবেন ২৭ সেপ্টেম্বর। নিউইয়র্কের একটি কূটনৈতিক সূত্র অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ২৭ সেপ্টেম্বর ড. ইউনূসের ভাষণ দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তবে প্রধান উপদেষ্টা ঠিক কবে নিউইয়র্কের উদ্দেশে যাত্রা করবেন, তা নির্ভর করছে সেখানে তাঁর সরকারি কর্মসূচি ঠিক কবে শুরু হবে, তার ওপর। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রধান উপদেষ্টার এবারের নিউইয়র্ক সফরে সরকারি প্রতিনিধিদলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনসহ সব মিলিয়ে ২৫ জন থাকতে পারেন।

অর্থাৎ, এ বিষয়ে সর্বশেষ সংবাদেও জাতিসংঘের অধিবেশনে ড. ইউনূস যাচ্ছেন দাবিতেই সংবাদ পাওয়া যায়৷ বাতিল হওয়ার সপক্ষে নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।

সুতরাং, শেখ হাসিনা জাতিসংঘে যাওয়ার নিমন্ত্রণ পেয়েছেন এবং ড. ইউনূসের জাতিসংঘের ভাষণ বাতিল করা হয়েছে শীর্ষক দাবিগুলো মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img