ড. আফিয়া সিদ্দিকীর মৃত্যুর সংবাদটি গুজব

সম্প্রতি বিদায়_নিলেন_আফিয়া_সিদ্দিকা ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!” শীর্ষক শিরোনামে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। 

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, পাকিস্তানি নিউরো সায়েন্টিস্ট ড. আফিয়া সিদ্দিকার মৃত্যুর সংবাদটি সত্য নয় বরং ২০১৬ সাল থেকেই তার মৃত্যুর গুজবটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার হয়ে আসছে।

কী-ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে পাকিস্তানের গণমাধ্যম dawn.com এ চলতি বছরের ৩ জুলাই “Aafia’s mother passes away” ( আফিয়ার মা মারা গেছেন) শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কারাগারে বন্দী থাকা ড. আফিয়া সিদ্দিকীর মা ইসমত সিদ্দিকী ৮০ বছর বয়সে মারা গেছেন।

আফিয়া মুভমেন্ট পাকিস্তানের মুখপাত্র মুহাম্মদ আয়ুবের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমটি জানায়, আফিয়ার মা কিডনি ও শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। তবে এ প্রতিবেদনের কোথাও ড. আফিয়া সিদ্দিকীর সবশেষ অবস্থা সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।

অপরদিকে The Afia Foundation নামের একটি ওয়েবসাইটে ড. আফিয়া সিদ্দিকী সম্পর্কে কিছু তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়। ওয়েবসাইটটিতে দেওয়া তথ্য মতে, ড. আফিয়া সিদ্দিকীর স্বাস্থ্যগত ( মানসিক ও শারিরীক) অবস্থা ভালো নয়। তার পরিবার ও সমর্থকেরা সরকারের কাছে তার জন্য স্বাধীন চিকিৎসা টিম পাঠানোর অনুরোধ করলেও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সফলতা পাওয়া যায়নি। 

পাশাপাশি পাকিস্তান সহ আন্তর্জাতিক কোনো গণমাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে আফিয়া সিদ্দিকীর মৃত্যু নিয়ে কোনো সংবাদ খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

এদিকে ড. আফিয়া সিদ্দিকীর মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে এর আগেও বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইন্টারনেটে গুজব ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা খুঁজে পাওয়া যায়। 

২০১৬ সালের গুজব

somewhereinblog.net এ ২০১৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি “ড.আফিয়া সিদ্দিকী মরে গিয়ে প্রমান করেছিলেন-মালালা জীবিত থেকেও মৃত।” শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হয়, “বিশ্বের একমাত্র নিউরো সাইন্টিস্ট ড.আফিয়া সিদ্দিকী অবশেষে মুক্তি পেলেন নারকীয় যন্ত্রনা থেকে। ড. আফিয়া সিদ্দিকী মরে গিয়ে বরং বেঁচেই গেলেন।”

তবে ভারতীয় গণমাধ্যম India.com এ ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ “Aafia Siddiqui dead or alive? Unrest in Pakistan over death rumours of imprisoned female terror suspect” শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, পাকিস্তানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসমর্থিত সূত্রের মাধ্যমে সেসময় ড. আফিয়া সিদ্দিকীর মৃত্যুর সংবাদ প্রচার হলে পাকিস্তানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। 

তবে প্রতিবেদনটিতে হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্কের সভাপতি ইন্তেখাব আলম সূরিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ড. আফিয়া সিদ্দিকীর মৃত্যুর সংবাদটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানানো। 

২০১৮ সালের গুজব

২০১৮ সালের নভেম্বরেও “অবশেষে বিদায় নিলেন একজন হাফেজা বিশ্বের একমাত্র নিউরো সাইন্টিস্ট ডঃআফিয়া সিদ্দিকা। ধিক্কার জানাই বিশ্বের মানবতা, হে আল্লাহ তুমি তোমার পবিত্র কোরআনের বাণী ধারনকৃত। ডঃ আফিয়া সিদ্দিকাকে জান্নাতের সবোর্চ্চ মযার্দা দান করো” শীর্ষক শিরোনামে বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ড. আফিয়া সিদ্দিকীর মৃত্যুর সংবাদ খুঁজে পাওয়া যায়। 

তবে দেশীয় গণমাধ্যম দৈনিক যুগান্তরে ২০১৮ সালের ২৫ মে “টেক্সাসে ড. আফিয়ার মৃত্যুর খবর উড়িয়ে দিলেন পাকিস্তানি কূটনীতিক” শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে পাকিস্তানি গণমাধ্যম ডন অনলাইনকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ড. আফিয়া সিদ্দিকীর মৃত্যুর খবর ভিত্তিহীন ও মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের হাউসটনে পাকিস্তানের কনসাল জেনারেল আয়েশা ফারুকী।

কারসওয়েলে গিয়ে তিনি ড. আফিয়া সিদ্দিকীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী তাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।

২০২১ সালের গুজব

২০২১ সালের ২ ডিসেম্বরও বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ” বিদায় নিলেন আফিয়া সিদ্দিকা,  হাজার স্যালুট প্রিয় বোন তোমাকে, এই সেই আফিয়া সিদ্দিকা যিনি ছিলেন নিউরো   সাইন্টিস্ট,যিনি ছিলেন এক জন পি. এইচ. ডি. হোল্ডার এবং যিনি ছিলেন এক জন কোরআন হাফেজা।” শীর্ষক শিরোনামে ড. আফিয়া সিদ্দিকীর মৃত্যুর সংবাদ প্রচার করা হয়। 

তবে পাকিস্তানি গণমাধ্যম Times of Islamabad এ ২০২১ সালের ৩০ এপ্রিল “Is Dr Aafia Siddiqui dead in US jail?” শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

প্রতিবেদনটিতে ড. আফিয়া সিদ্দিকীর বোন ড. ফৌজিয়া সিদ্দিকীকে উদ্ধৃত করে জানানো হয়, তার বোন ড. আফিয়া সিদ্দিকী আমেরিকান কারাগারে জীবিত আছেন। আমেরিকান কারাগার কর্তৃপক্ষ তার জীবিত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। 

উল্লেখিত বছরগুলো ছাড়াও ২০১৭ (আর্কাইভ), ২০১৯ (আর্কাইভ) , ২০২০ (আর্কাইভ) সালেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একইভাবে তার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল।

এছাড়া  ড. আফিয়া সিদ্দিকী দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচারিত ছবিটি রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে মিশরীয় গণমাধ্যম Ahram Online এ “PHOTO GALLERY: Egyptian activists on hunger strike, behind bars – Who’s Who?” শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত প্রতিবেদনে একটি ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। 

ছবিটির শিরোনাম থেকে জানা যায়, ড. আফিয়া সিদ্দিকী দাবিতে প্রচারিত এই ছবিটি মূলত মিশরের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুরসির সমর্থক আমিন আল শরিফীর মেয়ে কারিমা ই-শরিফীর। তার বিরুদ্ধে বিদেশি রাষ্ট্রের হাতে জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত নথিপত্র ফাঁস করে দেওয়ার অভিযোগ আনে মিশর সরকার। 

মূলত, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদেরকে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে ২০১০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের একটি আদালত স্নায়ুবিজ্ঞানী ড. সিদ্দিকীকে ৮৬ বছর কারাদণ্ড দেন। এরপর থেকে তিনি কারাগারেই বন্দী আছেন৷ এর মধ্যেই ২০১৬ সাল থেকে প্রতিবছরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইন্টারনেটে তার মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে গুজব ছড়ানো হয়েছে। এছাড়া তার সবশেষ মৃত্যুর সংবাদের ব্যাপারেও পাকিস্তান সহ আন্তর্জাতিক কোনো গণমাধ্যমে  সংবাদ খুঁজে পাওয়া যায়নি।

প্রসঙ্গত, ১৯৯০ সালে পাকিস্তানের করাচী থেকে থেকে আমেরিকায় এসে তার দুই ভাই টেক্সাসের হাউসটনে বসবাস করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে স্নাতক ও ব্রেন্ডেইস ইউনিভার্সিটি থেকে নিউরোসায়েন্সের উপর পিএইচডি সহ স্নাতক সম্পন্ন করেন। পাশাপাশি তিনি সেখানে ইসলামের প্রচার ও মানবিক কাজের জন্যও সেখানে পরিচিত ছিলেন।

তবে ২০০২ সালের ড. আফিয়া সিদ্দিকী সপরিবারে পাকিস্তানে ফিরে আসলেও তার ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে  ২০০১ সালের ৯/১১ এর ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকার ব্যাপারে সন্দেহ করা হয়। 

পরবর্তীতে ২০০৩ সালের মার্চে করাচী থেকে ইসলামাবাদে যাওয়ার পথে তিন সন্তান সহ নিখোঁজ হন ড. আফিয়া সিদ্দিকী। অতঃপর ২০০৮ সালে খোঁজ পাবার আগ পর্যন্ত তিনি ৫ বছর নিখোঁজ ছিলেন। পরে ২০১০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদেরকে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে নিউইয়র্কের একটি আদালত স্নায়ুবিজ্ঞানী ড. সিদ্দিকীকে  ৮৬ বছর কারাদণ্ড দেন। 

এছাড়া আফিয়া সিদ্দিকীর সবশেষ অবস্থা নিয়ে চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারিতে প্রকাশিত বার্তা সংস্থা এপিরও একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে আফিয়া সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে  আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, উগ্রবাদের মতো ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে  অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু এই প্রতিবেদনটিতেও তার মৃত্যুর ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই। 

সুতরাং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পাকিস্তানি নিউরো সায়েন্টিস্ট ড. আফিয়া সিদ্দিকার মৃত্যুর সংবাদটি সত্য নয়; এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

dawn.com: Aafia’s mother passes away

The Afia Foundation: Who is Dr. Aafia Siddiqui…And Why Should We Care?

India.com: Aafia Siddiqui dead or alive? Unrest in Pakistan over death rumours of imprisoned female terror suspect

Daily Jugantor: টেক্সাসে ড. আফিয়ার মৃত্যুর খবর উড়িয়ে দিলেন পাকিস্তানি কূটনীতিক

Times of Islamabad: Is Dr Aafia Siddiqui dead in US jail?

Apnews.com: A closer look at the case of Aafia Siddiqui, jailed in Texas
BBC News: US jails Pakistani scientist for 86 years

আরও পড়ুন

spot_img