‘সাধুর নগরে বেশ্যা মরেছে’ শীর্ষক কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা নয় 

দীর্ঘদিন ধরে ‘সাধুর নগরে বেশ্যা মরেছে’ শীর্ষক একটি কবিতা বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। 

২০২২ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 

২০২৩ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 

ইউটিউবে প্রচারিত কিছু ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে(আর্কাইভ)। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়,  সাধুর নগরে বেশ্যা মরেছে শীর্ষক কবিতাটি  কবি কাজী নজরুল ইসলামের নয়। প্রকৃতপক্ষে এই কবিতাটি শেখ সাজ্জাদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির লেখা, যা ২০২২ সাল থেকে কাজী নজরুল ইসলামের নামে প্রচার হয়ে আসছে।

কবিতাটির প্রকৃত লেখকের অনুসন্ধানে রিউমর স্ক্যানার টিম দীর্ঘ অনুসন্ধান চালায়৷ 

এক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়ে ওপেন সোর্স অনুসন্ধানে ২০২০ সালের ২৮ নভেম্বর সাংবাদিক তৌফিক তাপস নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ‘সাধুর নগরে “বেশ্যা” মরেছে লাশটি দাফন করবে কে?‘ শীর্ষক একটি পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot: সাংবাদিক তৌফিক তাপস Facebook Post

পোস্টটির কমেন্টবক্সে পোস্টদাতা কবিতাটির লেখক হিসেবে Toufik Meem (তৌফিক মীম) নামে জনৈক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেন৷ 

Screenshot: সাংবাদিক তৌফিক তাপস Facebook Post

তার এই কমেন্টের সূত্রে রিউমর স্ক্যানার টিম Toufik Meem (তৌফিক মীম) এর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানান, এই কবিতাটি তার লেখা নয়। তিনি কবিতাটি তার এক ছোট ভাই থেকে সংগ্রহ করেছেন। তবে তিনি তার এই ছোট ভাই সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারেননি। 

এটি ছাড়াও একই বছরের ৬ অক্টোবর Sadin Akon Rubel  নামে এক ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে উক্ত কবিতাটি তার নিজের নামে পোস্ট করা দেখা হয়।

Screenshot: Sadin Akon Rubel Facebook Post

এছাড়া ২০২১ সালেও বিভিন্ন সময়ে উল্লেখিত কবিতাটি সংগৃহীত সূত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হতে দেখা যায়। ২০২১ সালে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে। 

এ পর্যন্ত অনুসন্ধানে কোথাও কবিতাটির সঙ্গে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কোনো সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এ পর্যায়ে রিউমর স্ক্যানার টিমের আরও অধিকতর অনুসন্ধানে আলোচিত কবিতাটির সঙ্গে ২০২২ সালে প্রথম জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামের সম্পৃক্ততার সন্ধান মিলে। 

Screenshot: Facebook Post

২০২২ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। একই ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালেও এমন কিছু পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায়। দেখুন দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

এসব পোস্টে কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলামের দাবি করা হলেও কবিতাটি তার কোন কাব্যগ্রন্থের এমন কোনো তথ্য পোস্টগুলো থেকে জানা যায় না।

পরবর্তীতে চলতি বছরের গত ১৬ এপ্রিল শেখ সাজ্জাদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি রিউমর স্ক্যানারের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপে যোগাযোগ করে কবিতাটি তার নিজের বলে দাবি করেন। তার এ দাবির প্রেক্ষিতে রিউমর স্ক্যানার টিম শেখ সাজ্জাদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করে। 

কবিতাটি রচনার প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানান, ২০১৯ সালের শেষদিকে খুলনার রূপসার রহিমনগর এলাকায় একজন পতিতা খুন হন। এসময় তার জানাজা পড়া ও তাকে দাফন করা নিয়ে এলাকায় অনেক বাজে পরিস্থিতির তৈরি হয়। এই ঘটনা অবলম্বনে তিনি ২০১৯ সালে ‘সাধুর নগরে বেশ্যা মরেছে’ শীর্ষক কবিতাটি লিখেছিলেন এবং পরবর্তীতে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন। 

যেভাবে প্রমাণ হলো কবিতাটি শেখ সাজ্জাদুল ইসলামের

অপরদিকে তার উপরিউক্ত দাবির সত্যতা যাচাইয়ে কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানে খুলনার রূপসা উপজেলার দক্ষিণ নন্দনপুর গ্রামে ২০১৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর লাকি খাতুন নামে এক নারীর খুনের সংবাদ খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot: Bangla Tribune 

পরবর্তীতে অধিকতর অনুসন্ধানে খুলনার স্থানীয় অনলাইন পোর্টাল Khulna Gazette এ ২০২২ সালের ১৫ জানুয়ারি ‘রূপসার লাকী হত্যার রহস্য উদঘাটন করলো পিবিআই, তিন জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot: Khulna Gazette 

এই প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালে  নিহত লাকী দেহ ব্যবসা ও মাদকের সঙ্গে জড়িত ছিল। এসবের সূত্রেই হত্যার শিকার হন লাকি খাতুন। 

Screenshot: Khulna Gazette

সাধুর নগরে বেশ্যা মরেছে’ শীর্ষক কবিতার লেখক দাবি করা শেখ সাজ্জাদুল ইসলামের বর্ণিত ঘটনার সঙ্গে উপরিউক্ত সংবাদ দুইটির যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। 

পরবর্তীতে রিউমর স্ক্যানার টিম ‘সাধুর নগরে বেশ্যা মরেছে’ শীর্ষক কবিতাটি নিয়ে শেখ সাজ্জাদুল ইসলামের দাবির সত্যতা যাচাইয়ে আরও অনুসন্ধান করে। 

অনুসন্ধানে দেখা যায়, উক্ত কবিতাটি Md Saddam Hossain নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ২০২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ‘পতিতার লাশ’ শীর্ষক শিরোনামে প্রচার করা হয়। পোস্টে আরও উল্লেখ করা হয়,  Husain Mohammod Sazzad, রহিম নগর এলাকার বাস্তব ঘটনা উপরে লিখেছেন এই কবিতাটি লিখেছেন। 

Screenshot: Md Saddam Hossain Facebook Post

এছাড়া ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরেও Tania Akter Taane নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টের পোস্টেও ‘পতিতার লাশ’ শীর্ষক শিরোনামে আলোচিত কবিতাটি খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot: Tania Akter Taane Facebook Post 

এই কবিতাটিতেও ‘Husain Mohammod Sazzad’ নামে এক ব্যক্তিকে উদ্ধৃত করা হয়। 

এছাড়া রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানেও ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের পূর্বে কবিতাটি ইন্টারনেট বা ফেসবুকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

Husain Mohammod Sazzad সম্পর্কে শেখ সাজ্জাদুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানান, এটি তারই অ্যাকাউন্ট ছিল। তবে করোনার সময় অ্যাকাউন্টটি ডিজেবল হয়ে যায়। যা পরবর্তীতে তিনি আর উদ্ধার করতে পারেননি।

পাশাপাশি তিনি রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, ‘পতিতার লাশ’ শীর্ষক কবিতাটি লেখার পর তিনি এটি দৈনিক দেশপত্র নামের একটি পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক রিয়াদুল হাসানকে দেখিয়েছিলেন। 

তার এ দাবির সত্যতা যাচাইয়ে রিউমর স্ক্যানার টিম রিয়াদুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানান, আলোচিত কবিতাটি বছর কয়েক আগে সাজ্জাদুল ইসলাম তাকে দেখিয়েছিলেন। যদিও কবিতাটি তিনি তার পত্রিকায় ছাপাননি। 

পাশাপাশি তিনি আরও বলেন, এটা নজরুলের লেখা হতেই পারে না। নজরুলের লেখা হলে অবশ্যই এটি নজরুল রচনাবলীতে পাওয়া যেত।

রিউমর স্ক্যানার টিমের বিস্তারিত অনুসন্ধানেও কাজী নজরুল ইসলামের এমন কোনো কবিতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

সার্বিক বিষয়ে শেখ সাজ্জাদুল ইসলাম রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, আমি কাজী নজরুল ইসলামের একজন অনুরাগী। আমার মতো একজন মানুষের লেখা কবিতাকে কাজী নজরুল ইসলামের মতো মহান কবির নামে চালিয়ে দেওয়াটা খুবই খারাপ এবং ব্যাপারটা খুবই বিব্রতকর।

উল্লেখ্য, শেখ সাজ্জাদুল ইসলাম খুলনার রূপসা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন।  বর্তমানে তিনি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডিগ্রি করছেন এবং কর্মসূত্রে কুমিল্লায় বসবাস করছেন।

অর্থাৎ, রিউমর স্ক্যানার টিমের সার্বিক অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয় যে, দীর্ঘদিন ধরে  ‘সাধুর নগরে বেশ্যা মরেছে’ শীর্ষক যে কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলামের নামে প্রচার হয়ে আসছে, সেটি তার লেখা নয়। প্রকৃতপক্ষে কবিতাটি লিখেছিলেন শেখ সাজ্জাদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি।

মূলত, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে খুলনার রূপসার রহিমনগর এলাকায় দেহ ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত লাকী খাতুন নামে এক নারী হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। উক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে সেই বছরই শেখ সাজ্জাদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি ‘পতিতার লাশ’ শীর্ষক একটি কবিতা রচনা করেন৷ যা ২০২০ সালে ফেসবুকে প্রকাশ করেন তিনি। পরবর্তীতে তার লেখা এই কবিতাটি বিভিন্নজনের নামে প্রচার হতে হতে এক পর্যায়ে ২০২২ সালে এসে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নামে প্রচার হতে থাকে।

সুতরাং, দীর্ঘদিন ধরে ‘সাধুর নগরে বেশ্যা মরেছে’ শীর্ষক কবিতাকে কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা কবিতা দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img