গত ২৭ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি এক কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের প্রতিবাদে অবরোধের মধ্যে উত্তেজনা ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৪৪ ধারা জারি করে জেলা প্রশাসন। জুম্ম ছাত্র-জনতার সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষে খাগড়াছড়ির গুইমারায় অন্তত ৩ জন নিহত হয়েছেন। এরই প্রেক্ষিতে একটি গাড়ি থেকে টুপি পাঞ্জাবি পরে লাঠিসোঁটা হাতে বেশ কয়েকজন ব্যক্তির নামার একটি ভিডিও গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাত থেকে প্রচার করে দাবি করা হয়েছে, ‘ব্রেকিং নিউজ গুইমারাতে উত্তেজনা বাড়ছে | বিভিন্ন জায়গা থেকে লাঠিসোটা ও দেশীয় অস্ত্রসহ সেটেলার বাঙালীরা গুইমারায় একত্রিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে পুরো গুইমারা সদরে সেনাবাহিনী নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দিয়েছে। রাতের মধ্যেই জুম্ম আদিবাসীদের উপর বড় ধরণের হামলার পরিকল্পনা চলছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’

এরূপ দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
এরূপ দাবিতে ইনস্টাগ্রামে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত ভিডিওটি খাগড়াছড়ির গুইমারার নয়। প্রকৃতপক্ষে, ভিডিওটি গত ৬ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে ফেসবুকে ‘আপত্তিকর পোস্ট’ নিয়ে সৃষ্ট উত্তেজনার প্রেক্ষিতে হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের লাঠিসোঁটা হাতে অবস্থান নেওয়ার ঘটনার।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটির একাধিক কি-ফ্রেম নিয়ে রিভার্স সার্চে চট্টগ্রাম ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘সি ভিশন’ এর ফেসবুক পেজে গত ৭ সেপ্টেম্বর (৬ সেপ্টেম্বর দিবাগত) রাত ৩ টা ১৫ মিনিটে একটি ভিডিও পোস্ট পাওয়া যায়। ভিডিওটির সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওর মিল পাওয়া যায়।

ভিডিওটি সম্পর্কে ক্যাপশনে বলা হয়, ‘রাতে লা’ঠিসোটা হাতে যেভাবে অবস্থান নিয়েছিলো মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা #CVision #হাটহাজারী #মাদ্রাসা #সুন্নী #কওমি’
এছাড়াও, ভিডিওটি হাটহাজারী মাদ্রাসা ছাত্রদের দাবিতে গত ৭ সেপ্টেম্বরে আরো একাধিক ফেসবুক পোস্ট পাওয়া যায়।
পরবর্তীতে এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম আলো’র ওয়েবসাইটে গত ৮ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ৬ সেপ্টেম্বর জশনে জুলুসে যাওয়া গাড়িবহরের এক যুবক হাটহাজারী বড় মসজিদ লক্ষ্য করে আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি করে একটি ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করেন। ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়লে ওই দিন বিকেলে দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী বড় মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও কওমি লোকজন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। পরে ফটিকছড়ি থানা-পুলিশ ওই যুবককে আটক করে। সন্ধ্যার পর দুই পক্ষের মধ্যে কয়েক দফায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও ঢিল ছোড়াছুড়ির ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে শিক্ষার্থী ও কওমি লোকজন হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করেন। পরে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে মাদ্রাসার জ্যেষ্ঠ শিক্ষক আহমেদ দিদার কাসেমী মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে শিক্ষার্থীদের সড়ক ছেড়ে মাদ্রাসায় ঢুকে যেতে বলেন। এরপর মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও কওমি লোকজন মাদ্রাসার সামনে অবস্থান নেন। অন্যদিকে সুন্নি জনতা অবস্থান নেন হাটহাজারীর কাচারি সড়কে। উভয় পক্ষ টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। দুই পক্ষের মধ্যে ইটপাটকেল ও ঢিল ছোড়াছুড়িতে দেড় শতাধিক মানুষ আহত হন। এর মধ্যে অন্তত ১২৭ জনকে হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়।’
একইরকম তথ্য বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে গত ৭ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকেও জানা যায়। তবে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘..সুন্নি আকিদার অনুসারীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা তাদের বাসে গরম পানি ছুড়ে মেরেছিল। হাটহাজারী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজী মুহাম্মদ তারেক আজিজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “দুই পক্ষই একে একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছে। একপক্ষ বলছে তাদেরকে পানি মারা হয়েছে। অন্য পক্ষ বলছে তাদের অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি দেখানো হয়েছে। এখন কোনটা আগে হয়েছে কোনটা পরে হয়েছে এটা এখনো আমরা নিশ্চিত নই”।’
এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে প্রচারিত ভিডিওটির সাথে খাগড়াছড়ি বা পাহাড়ের কোনো সম্পৃক্ততা নাই। অপরদিকে খাগড়াছড়িতে চলমান উত্তেজনার সূত্রপাত গত মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) রাত ৯টায় প্রাইভেট পড়ে ফেরার পথে স্কুলছাত্রী কিশোরী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হওয়ার মধ্য দিয়ে।
সুতরাং, চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ভিন্ন ঘটনার ভিডিওকে খাগড়াছড়ির গুইমারায় লাঠিসোঁটা নিয়ে বাঙালিদের জড়ো হওয়ার ভিডিও দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- C Vision – রাতে লা’ঠিসোটা হাতে যেভাবে অবস্থান নিয়েছিলো মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা
- Prothom Alo – হাটহাজারীতে দুই পক্ষের সংঘর্ষের পরদিন ওসিকে প্রত্যাহার
- BBC News Bangla – হাটহাজারিতে মাদ্রাসা অবমাননার অভিযোগ কেন্দ্র করে যেভাবে সংঘর্ষ শুরু
- Prothom Alo – খাগড়াছড়িতে কী হচ্ছে, এখন পর্যন্ত যা যা ঘটল
- Rumor Scanner’s analysis