সম্প্রতি, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক সফর শেষে গত ০৬ মার্চ দেশে ফিরেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। এরই প্রেক্ষিতে ভারতীয় গণমাধ্যমসহ সামাজিক মাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে, সেনাপ্রধান দেশে ফেরার পর তাকে বহনকারী বিমান ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করেনি। অবতরণ করেছে তেজগাঁও বিমানবন্দরে। একই সাথে এও দাবি করা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছে। এই চেষ্টায় জড়িত হিসেবে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়জুর রহমানসহ ১১ জন সেনা কর্মকর্তার বিষয়ে বলা হয়েছে।

উক্ত দাবিতে ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখুন আজতক বাংলা (ইউটিউব), আজতক বাংলা, ইকোনমিক টাইমস, ইন্ডিয়া টুডে, টাইমস নাউ।
একই দাবিতে ফেসবুকের পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
একই দাবিতে এক্সে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সেনা অভ্যুত্থান সংক্রান্ত দাবিটি সঠিক নয় বরং প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং পরে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচার হওয়া আলোচিত দাবিটি সম্পূর্ণ ভুয়া। আইএসপিআরের পক্ষ থেকেও রিউমর স্ক্যানারকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
এ বিষয় অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিগুলোর সূত্রপাতের খোঁজ চালায় রিউমর স্ক্যানার। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সেনাপ্রধান দেশে ফেরার পরদিন থেকেই ফেসবুকে এই দাবিটি করা হচ্ছিল যে, “তিনি নির্ধারিত সময়ের ৫-৬ ঘন্টা আগে ঢাকা পৌঁছে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে না নেমে তেজগাঁও বিমানবন্দরে তাকে নিয়ে আসা বিমান অবতরণ করান।” হাওলাদার আব্দুর রশিদ নামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ০৭ মার্চ রাত ৯ টা ৪৭ মিনিটে এ সংক্রান্ত সম্ভাব্য প্রথম পোস্টটি করা হয়।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়জুর রহমানের বিষয়ে আলোচিত দাবিটি প্রচারের সম্ভাব্য উৎস হিসেবে এক্সের নাম এসেছে। প্লাটফর্মটিতে গত ৯ মার্চ ‘Nepal Correspondence’ নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ‘𝐉𝐔𝐒𝐓 𝐈𝐍: 𝐂𝐎𝐔𝐏 𝐏𝐑𝐄𝐕𝐄𝐍𝐓𝐄𝐃 𝐈𝐍 𝐁𝐀𝐍𝐆𝐋𝐀𝐃𝐄𝐒𝐇 𝐀𝐑𝐌𝐘’ শিরোনামে আলোচিত দাবিটি প্রচার করা হয়।

Nepal Correspondence নামের এই অ্যাকাউন্টটি পূর্বে থেকেই বাংলাদেশ বিষয়ে বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর ও অপপ্রচারমূলক তথ্য ছড়ানোর জন্য পরিচিত।
অর্থাৎ, এ সংক্রান্ত দাবিগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রথম প্রচার হতে দেখা যায়। এসব পোস্ট বিশ্লেষণ করে রিউমর স্ক্যানার দাবিগুলোর বিপরীতে কোনো প্রমাণ বা সূত্রের উল্লেখ পায়নি।
পরবর্তীতে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে আজতক বাংলা ১০ মার্চ সকাল ৮.৩০ টা মিনিটে সমজাতীয় দাবি নিয়ে তথ্য প্রচারের পর দেশটির অন্যান্য গণমাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইকোনমিক টাইমস “Bangladesh Army coup plot thickens as pro-Pakistan Lt General put under surveillance” শিরোনামে গত ১০ মার্চ প্রকাশিত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, “লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়জুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি অংশ বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা করছে। অভ্যুত্থানের প্রতি সমর্থন যাচাই করার জন্য রহমান একটি সভা ডেকেছিলেন কিন্তু তার উপস্থিতি সীমিত ছিল। সামরিক গোয়েন্দারা এখন তার উপর নজর রাখছে এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আরও খারাপ হতে পারে। এই ষড়যন্ত্রে বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা জড়িত।”
ইকোনমিক টাইমসের এই প্রতিবেদনটি দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী নামের এক ভারতীয় সাংবাদিক লিখেছেন, যার আগে থেকেই বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক, অপপ্রচারমূলক প্রতিবেদন প্রকাশের ইতিহাস রয়েছে। ৫ আগস্টের পরেও তিনি বাংলাদেশ নিয়ে কয়েকটি অপপ্রচারমূলক প্রতিবেদন করেছেন। যার মধ্যে আছে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা।
এছাড়াও, এর পূর্বে একই বিষয়ে একই গণমাধ্যম গত ২৬ জানুয়ারি “বাংলাদেশ সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে” (অনূদিত) শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।
বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে এ সংক্রান্ত কোনো সংবাদ না পেয়ে গতকাল সন্ধ্যায় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালকের সাথে কথা বলে রিউমর স্ক্যানার৷ তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানান, সেনাপ্রধানের সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক সফরে তিনি নিজেও সফরসঙ্গী ছিলেন। তাদের বহনকারী বিমান ০৬ মার্চ শাহজালাল বিমানবন্দরেই অবতরণ করে।
একই সাথে জেনারেল ফয়জুর রহমানের সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা, এর ফলে তাকে সরিয়ে দেওয়া সংক্রান্ত দাবিগুলো ভুয়া বলে উল্লেখ করেছে আইএসপিআর কর্তৃপক্ষ।
বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীতে গতকাল রাতে রিউমর স্ক্যানারের কাছে একটি প্রতিবাদলিপির কপি পাঠিয়েছে আইএসপিআর। পরবর্তীতে প্রতিবাদলিপিটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসিয়াল ফেসবুক পেজেও পোস্ট করা হয়েছে। ‘Rejoinder: Response to False Reports on Bangladesh Army by Certain Media Outlets from India’ শিরোনামে এই প্রতিবাদলিপিতে লেখা হয়,
“বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করেছে যে, ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম, বিশেষ করে The Economic Times ও India Today, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা এবং কমান্ড চেইনের ভঙ্গুরতা নিয়ে একাধিক ভিত্তিহীন ও মনগড়া প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর এবং বাংলাদেশ ও এর সশস্ত্র বাহিনীর স্থিতিশীলতা ও ভাবমূর্তি নষ্ট করার উদ্দেশ্যে চালানো একটি পরিকল্পিত অপপ্রচার বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।”
সুতরাং, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের ‘ব্যর্থ ক্যু’ সংক্রান্ত খবরটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
Rumor Scanner’s own investigation
Statement from ISPR