এনসিটিবির পাঠ্য বইয়ের নয়, ‘ঝর্ণার গল্প’ শিরোনামের পাঠের ছবিটি পুরোনো একটি পাইলট প্রকল্পের বইয়ের

গত ০৮ জানুয়ারি এইচএসসি বিষয়ক একটি গ্রুপে মো: মেহেদী হাসান রিমন নামে এক ব্যক্তি একটি বইয়ের পাতার ছবি পোস্ট (আর্কাইভ) করেন। বইয়ের এই পাতায় ‘ঝর্ণার গল্প’ শিরোনামের পাঠ্যতে একটি শিশুকে দেখা যাচ্ছে। তার পাশে লেখা রয়েছে, “সে খেয়াল করলো তার বুকের দু’পাশটা ফুলে যাচ্ছে এবং বগলে ও যৌনাঙ্গে চুল গজাচ্ছে।” 

উক্ত ব্যক্তি এই পোস্টের ক্যাপশনে লিখেছেন, “এটাও শিখাইতে হবে? জেমস ডায়েরি নামক একটা বই মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদেরকে দেওয়া হচ্ছে। এদের আসলে উদ্দেশ্য কি? একটা বেহায়া প্রজন্ম তৈরি করা?” জনাব রিমন তার পোস্টের কমেন্টে আলোচিত বইটির কাভারের ছবিও যুক্ত করেছেন যাতে বইটির নাম ‘আমার জেমস ডায়েরি’ উল্লেখ রয়েছে। এটাও উল্লেখ রয়েছে, এটি জেনারেশন ব্রেকথ্রো প্রকল্পের বই। 

পাঠ্য বই

পোস্টের ছবিটি পরবর্তীতে ভিন্ন ভিন্ন ক্যাপশনে ফেসবুকে প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। 

আমাদের নজরে এমন পোস্টও (আর্কাইভ) এসেছে, যেখানে ছবির বইটিকে সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবই বলে দাবি করা হয়েছে। 

তাছাড়া, এই বইকে নতুন শিক্ষা কারিকুলামের বই বলেও প্রচার করতে দেখা গেছে কিছু পোস্টে। 
এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বইয়ের ভেতরের পৃষ্ঠার প্রচারিত ছবিটি সপ্তম শ্রেণি বা দেশের কোনো পাঠ্য বইয়ের পৃষ্ঠার ছবিই নয় বরং ২০২২ সালে দেশের কিছু জেলার নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শেষ হওয়া একটি পাইলট প্রকল্পের জন্য তৈরি করা বইয়ের ছবিকে উক্ত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে। 

এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে ‘আমার জেমস ডায়েরি’ নামের আলোচিত বইটির পিডিএফ সংস্করণ অনলাইনেই খুঁজে পেয়েছি আমরা। 

বইটির কাভারে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থার লোগো রয়েছে। এটি বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ যা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) কর্তৃক ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয়। বইটি পর্যবেক্ষণ করে জানা যাচ্ছে, এটি জেনারেশন ব্রেকথ্রু নামে একটি প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য প্রকাশ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের পরিচালক হিসেবে আছেন প্রফেসর ড. প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য্য, যিনি বইটির সার্বিক নির্দেশনায় রয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বইটি প্রকাশ করেছে ‘প্লান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ’ নামে একটি সংস্থা। তাছাড়া, বইটির সম্পাদনা ও পরিমার্জনের দায়িত্বে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) একাধিক কর্মকর্তা রয়েছেন। বইটির ৫৫ নং পৃষ্ঠায় আলোচিত ছবিটির সন্ধান মিলেছে যেখানে ১২ বছর বয়সী ঝর্ণা নামে এক মেয়ের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে কিনা তার শারীরিক কিছু পরিবর্তন নিয়ে চিন্তায় পড়েছে।

Screenshot collage: Rumor Scanner

আমরা অনুসন্ধানে বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে এই প্রকল্পটির বিষয়ে একটি প্রতিবেদন খুঁজে পেয়েছি। ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ প্রকাশিত প্রতিবেদনটি থেকে জানা যাচ্ছে, নির্দিষ্ট কিছু বিদ্যালয়ে গত ৫ বছর ধরে বাংলাদেশ সরকারের ‘জেনারেশন ব্রেকথ্রু’ নামের একটি প্রকল্পের আওতায় একটি শ্রেণীকক্ষ তৈরি করা হয়েছে। কক্ষটির নাম দেয়া হয়েছে ‘কিশোর কিশোরী কর্নার’। আর এখানে তারা পড়ছে ‘জেমস’ নামে একটি কোর্স যেটির পূর্ণরূপ দাঁড়ায় ‘জেন্ডার ইকুয়িটি মুভমেন্ট ইন স্কুলস’। এই প্রকল্পের আওতায় এসেছে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীরা। 

বিবিসি বাংলা লিখেছে, বিদেশী দাতাদের অর্থায়নে ২০১৪ সালে ৫ বছর মেয়াদী জেনারেশন ব্রেকথ্রু প্রকল্পটি শুরু হয় বাংলাদেশের চারটি জেলার ৩৫০টি বিদ্যালয়ে। এই প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে বিবিসি বাংলা ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেনের নাম উল্লেখ করেছে। 

ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলছিলেন, তারা অচিরেই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করতে যাচ্ছেন। সেখানে বিদ্যমান সাড়ে তিনশো বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত করা হবে আরো দুশোটি বিদ্যালয়।

Screenshot: BBC Bangla 

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন প্রকাশের দিন পাঁচেক পর ৩১ মার্চ জার্মান ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে বাংলা’র ওয়েবসাইটেও এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। 

ডয়চে ভেলে জানাচ্ছে, জেনারেশন ব্রেক থ্রু প্রকল্পটি নতুন ৫টি জেলার ২৫০টি স্কুলে আবার চালু হচ্ছে৷ ক্যানাডা সরকার অর্থায়ন করবে৷ আর সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের সব স্কুলে আগামী অর্থবছর থেকে চালু হবে৷ আর ২০২৩ সালের মধ্যে বাকি ৬টি বিভাগের ৫০ ভাগ স্কুলে চালুর পরিকল্পনা রয়েছে৷

Screenshot: DW Bangla

সে বছরই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় চালুর বিষয়ে জানা যায় এ সংক্রান্ত শিক্ষক সহায়িকা থেকে। তবে প্রকল্পটি বর্তমানে চালু রয়েছে কিনা সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। 

আমরা এ বিষয়ে জানতে শুরুতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার এবং এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) প্রফেসর মোঃ মশিউজ্জামানের সাথে কথা বলেছি। 

জনাব তপন কুমার সরকার জানান, তিনি এ প্রকল্প সম্পর্কে এই মুহূর্তে অবগত নন৷ 

জনাব মশিউজ্জামান রিউমর স্ক্যানারকে বলেছেন, “এই প্রকল্প আমাদের নয়। এটা মাউশির (মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর) প্রকল্প। তাই মেয়াদ জানা নেই। মাউশি থেকে বিস্তারিত জানা যাবে। 

আমরা পরবর্তীতে প্রকল্পটির ২য় পর্যায়ের পরিচালক এবং মাউশির প্রশিক্ষণ উইংয়ের পরিচালক ড. প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য্যের সাথে এ বিষয়ে কথা বলেছি। তিনি রিউমর স্ক্যানারকে বলেছেন, প্রকল্পটি বর্তমানে চালু নেই। ২০২২ সালেই এটি শেষ হয়ে গেছে। এর আগে চালু থাকা অবস্থায় নিয়মিত শ্রেণিকক্ষে এটি চালু ছিল না। এটির জন্য আলাদা শ্রেণিকক্ষ বরাদ্দ ছিল। সেখানেই এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হতো। 

অর্থাৎ, ছড়িয়ে পড়া পৃষ্ঠার ছবিটি যে বইয়ের তার সাথে বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম বা দেশের কোনো শ্রেণির পাঠ্যক্রমের সম্পর্ক নেই। 

তাছাড়া, এনসিটিবির ওয়েবসাইটে চলতি বছরের বইগুলো পর্যবেক্ষণ করে উক্ত পাতা সম্বলিত কোনো পাঠের খোঁজ মেলেনি। 

মূলত, ‘ঝর্ণার গল্প’ শিরোনামের পাঠ সম্বলিত একটি বইয়ের পৃষ্ঠার ছবিকে সম্প্রতি সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবই (কতিপয় পোস্টে নতুন শিক্ষা কারিকুলামের বই দাবি) বলে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু রিউমর স্ক্যানার টিম অনুসন্ধানে দেখেছে, আলোচিত পৃষ্ঠার ছবিটি ‘আমার জেমস ডায়েরি’ নামের একটি বইয়ের। এটির সাথে বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম বা দেশের কোনো শ্রেণির পাঠ্যক্রমের সম্পর্ক নেই। প্রকৃতপক্ষে, ২০১৪ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) কর্তৃক জেনারেশন ব্রেকথ্রু নামে একটি প্রকল্প চালু করা হয়। যার দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য ২০১৯ সালে বইটি প্রকাশ করা হয়েছিল। ২০২২ সালে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়। এর আগে প্রকল্পের আওতায় দেশের কিছু জেলার নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গতানুগতিক শ্রেণি কার্যক্রমের বাইরে আলাদা শ্রেণিকক্ষে বইটির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হতো। উক্ত বইটির একটি পৃষ্ঠার ছবি ব্যবহার করে আলোচিত দাবিগুলো প্রচার করা হচ্ছে।

সুতরাং, ২০২২ সালেই বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি পাইলট প্রকল্পের বইয়ের পৃষ্ঠার ছবিকে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম ও সপ্তম শ্রেণির বইয়ের ছবি দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।  

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img