- জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে ১৭৯৫টি ভুল তথ্য শনাক্ত।
- দ্বিতীয় প্রান্তিকে ভুল তথ্য শনাক্তের হার বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ।
- একক ব্যক্তি হিসেবে সর্বাধিক ভুল তথ্য ড. ইউনূসকে নিয়ে।
- রাজনৈতিক দলের মধ্যে বেশি অপতথ্যে আ’লীগের নাম।
- একক ইস্যু হিসেবে বেশি ভুল তথ্য ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ঘিরে।
- সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে ৭৪টি, পুলিশকে নিয়ে ৩০টি ভুল তথ্য শনাক্ত।
- সাম্প্রদায়িক অপতথ্য ও ভারতীয় গণমাধ্যমের অপপ্রচার কমেছে।
- ৩০৮টি ঘটনায় ৬১ সংবাদমাধ্যমকে জড়িয়ে ৩৩৩টি অপতথ্য।
২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশে প্রচার হয়েছে এমন ১৭৯৫টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। গত বছর একই সময়ের তুলনায় যা প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে রিউমর স্ক্যানার ভুল তথ্য শনাক্ত করেছিল ১৩৮০টি। এ বছর প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে ভুল তথ্য প্রচারের হার বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ। রাজনৈতিক বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ, আসন্ন সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা আর বৈশ্বিক একাধিক ঘটনার প্রেক্ষিতে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ভুল তথ্য প্রচারের হার বেড়েছে৷ এই সময়ে একক ব্যক্তি হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্যের শিকার হয়েছেন অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সাম্প্রতিক ইরান-ইসরায়েল সংঘাতকে ঘিরে একক ইস্যু হিসেবে বেশি ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে। তাছাড়া, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপতথ্যে জড়িয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নাম। রিউমর স্ক্যানারের ওয়েবসাইটে গত ছয় মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
মেটার প্লাটফর্মগুলোয় ভুয়া তথ্যের বন্যা
মেটার অধীনে থাকা দুই প্লাটফর্ম ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রামে গেল ছয় মাসে যথাক্রমে ১৬৬১ ও ২৫৫টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। জানুয়ারি থেকে জুনের প্রতিটি দিন কমপক্ষে গড়ে নয়টির বেশি ভুল তথ্য প্রচারিত হয়েছে ফেসবুকে। এছাড়া, ইউটিউবে ৩১১টি, এক্সে ২৫৭টি এবং টিকটকে ১৩৩টি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ছাড়াও দেশের গণমাধ্যমও ভুল তথ্য প্রচারের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। গত ছয় মাসে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে ভুল তথ্য, ছবি এবং ভিডিও সম্বলিত ফ্যাক্টচেক করা হয়েছে ৯০টি৷ এছাড়া, একই সময়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে অন্তত ২৫টি ঘটনায় বাংলাদেশকে জড়িয়ে অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে।
চলতি বছরের প্রথম দুই প্রান্তিকে রিউমর স্ক্যানারে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এই সময়ে পুরোপুরি মিথ্যা বা ভুয়া ঘটনা সম্বলিত ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে ১১২৫টি৷ এছাড়া, বিভ্রান্তিকর রেটিং দেওয়া হয়েছে ৩৮৬টি। বিকৃত রেটিং পেয়েছে ২৭৮টি। এছাড়া, সার্কাজম বা কৌতুক হিসেবে হাস্যরসাত্মক ঘটনাকে বাস্তব দাবির প্রেক্ষিতে ফ্যাক্টচেক করা হয়েছে ছয়টি। এসব ভুল তথ্য শনাক্তের ক্ষেত্রে তথ্য যাচাই করা হয়েছে ৭০৯টি, ছবি যাচাই করা হয়েছে ৩৩৬টি এবং ভিডিও যাচাই করা হয়েছে ৭৫০টি।
দ্বিতীয় প্রান্তিকে রাজনীতি-আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ভুল তথ্য বেড়েছে
প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে মার্চে ভুল তথ্য শনাক্ত হয় ৮৩৭টি। তবে পরের প্রান্তিকে (এপ্রিল থেকে জুন) তা প্রায় ১৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫৮টিতে। প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে ফেসবুকে ভুল তথ্য শনাক্তের হারও বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ। একই অবস্থা মেটার দুই প্লাটফর্ম ইনস্টাগ্রাম এবং থ্রেডসেও। এই দুই প্লাটফর্মে যথাক্রমে ১৮০ ও ১০০ শতাংশ হারে ভুল তথ্য শনাক্তের হার বেড়েছে। এছাড়া, ইউটিউবে দ্বিতীয় প্রান্তিকে ভুল তথ্য প্রচারের হার বেড়েছে প্রায় ৫১ শতাংশ। ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে এক্সে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে এই প্লাটফর্মে ভুল তথ্য শনাক্তের হার কমেছে ৪১ শতাংশ। তবে দুই প্রান্তিকে প্রায় সমান পরিমাণ ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে টিকটকে।
প্রান্তিক ভিত্তিক এই হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, দ্বিতীয় প্রান্তিকে জাতীয় ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে ভুল তথ্য শনাক্তের হার কমেছে যথাক্রমে প্রায় ১৪ ও ৪৪ শতাংশ। বিপরীত চিত্র দেখা গেছে, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলোতে। প্রথম প্রান্তিকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ৩৪৬টি অপতথ্য শনাক্ত হলেও পরের তিন মাসে পাঁচ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩৬৪টি। একইভাবে, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনাবলির কারণে প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে এই বিভাগে ভুল তথ্য শনাক্তের হার বেড়েছে প্রায় ৩১২ শতাংশ! প্রায় ৮৭ শতাংশ হারে বেড়েছে বিনোদন ও সাহিত্য অঙ্গনে ভুল তথ্য প্রচারের পরিমাণও। এই অঙ্গনে গেল ছয় মাসে সর্বাধিক ভুল তথ্যের (৭) শিকার হয়েছেন অভিনেত্রী সাদিয়া আয়মান। উল্টো চিত্র ছিল শিক্ষা এবং খেলাধুলায়। এই দুই ক্যাটাগরিতে যথাক্রমে প্রায় ২৯ এবং ১৪ শতাংশ হারে হ্রাস পেয়েছে ভুল তথ্যের পরিমাণ। ক্রীড়াঙ্গনে দুই প্রান্তিক মিলিয়ে সর্বাধিক ভুল তথ্য (৯) শনাক্ত হয়েছে ক্রিকেটার তামিম ইকবালকে জড়িয়ে।
আ’লীগ ও বিএনপি-জামায়াত: ইতিবাচক-নেতিবাচক প্রচারণার এপিঠ ওপিঠ
২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়া অপতথ্যগুলোয় সবচেয়ে বেশি নাম এসেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের। যদিও গত মে মাসে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সব সংগঠনের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। দলটি, দলটির বিভিন্ন সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন এবং নেতাকর্মীদের জড়িয়ে গত ছয় মাসে ২৪১টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার৷ এর মধ্যে শুধু দল হিসেবেই আওয়ামী লীগের নাম জড়িয়েছে ৫৯ অপতথ্যে। বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এসব অপতথ্যের প্রায় ৮৬ শতাংশই দলটির প্রতি ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। এই সময়ের মধ্যে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে সর্বাধিক অপতথ্য (৮৫) প্রচার করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
চলতি বছরের প্রথম দুই প্রান্তিকে বিএনপিকে জড়িয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (১৮৩) অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে দল হিসেবে শনাক্ত হওয়া ৪৭টি অপতথ্যের মধ্যে প্রায় ৯৪ শতাংশই দলটির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। এই সময়ের মধ্যে দলটির বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে জড়িয়ে সর্বাধিক অপতথ্য (২৪) শনাক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় সাড়ে ৮৭ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জড়িয়ে ২১টি অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫২ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
গেল ছয় মাসে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও এই দলটির অঙ্গ সংগঠন এবং নেতাকর্মীদের জড়িয়ে ১৪২টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এর মধ্যে দল হিসেবে জামায়াতকে জড়িয়ে প্রচার হয়েছে এমন অপতথ্য ছিল ৫৫টি। এসবের প্রায় ৯৩ শতাংশই দলটির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। এই সময়ের মধ্যে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান সবচেয়ে বেশি (২২) অপতথ্যের শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে প্রায় ৯১ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি নাহিদ ইসলামকে আহবায়ক করে গঠিত হয় নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ (এনসিপি)। দলটিকে জড়িয়ে পরের চার মাসে ৮৬টি অপতথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে দল হিসেবে এনসিপিকে জড়িয়ে প্রচার হয়েছে এমন অপতথ্য ছিল ১৭টি; যার সবগুলোতেই দলটিকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে জড়িয়ে ১১টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এসবের সবগুলোতেই তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে এনসিপির নেতাকর্মীদের মধ্যে গত ছয় মাসে সর্বাধিক অপতথ্য (২৭) ছিল দলটির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহকে নিয়ে। এই ২৭টির মধ্যে মাত্র একটি ছাড়া বাকিগুলোতে তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ভুল তথ্যের নিয়মিত শিকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার
গণ-আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত বছরের ০৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গেল বছর এই সরকারকে জড়িয়ে প্রচার হওয়া ১৩৫টি ভুল তথ্য শনাক্ত করে রিউমর স্ক্যানার। একই সময়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে জড়িয়ে ছড়ায় ১১০টি ভুল তথ্য। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে এই সরকারকে জড়িয়ে ৬৯টি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে। এসবের মধ্যে প্রায় ৯১ শতাংশ ভুয়া তথ্যের উপস্থাপনই ছিল সরকারের জন্য নেতিবাচক। এছাড়া, গেল ছয় মাসে ড. ইউনূসকে জড়িয়ে ১১২টি ভুয়া তথ্য শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৮৮ শতাংশ ক্ষেত্রেই তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে গত জুন পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারকে জড়িয়ে ২০৪টি ভুল তথ্যের প্রচার করা হয়েছে। একই সময়ে ড. ইউনূসকে জড়িয়ে প্রচার করা হয়েছে ২২২টি ভুল তথ্য।

এছাড়া এই সরকারের ১২ জন উপদেষ্টা এবং প্রেস সচিব শফিকুল আলমকে জড়িয়ে গেল ছয় মাসে সর্বমোট ৬৮টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ড. আসিফ নজরুলকে জড়িয়ে ১৪টি এবং জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে জড়িয়ে ১১টি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা এবং সশস্ত্র বাহিনীও ভুয়া তথ্যের লক্ষ্যবস্তু
দেশে সশস্ত্র এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জড়িয়ে এ বছরের প্রথম ছয় মাসে ১১৪টি ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার৷ গত বছর একই সময়ের তুলনায় এই হার বেড়েছে প্রায় ৭৮ শতাংশ। এর মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে সর্বোচ্চ ৭৪টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। গেল বছর একই সময়ে এই বাহিনীকে জড়িয়ে শনাক্ত হয়েছিল ৪২টি ভুল তথ্য। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে সেনাবাহিনীকে নিয়ে ভুল তথ্যের প্রচার বেড়েছে প্রায় ৭৬ শতাংশ। বাহিনীটির বর্তমান প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে নিয়ে গত ছয় মাসে ২৫টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।
এছাড়া বাংলাদেশ পুলিশকে নিয়ে ৩০টি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে এই ছয় মাসে। গেল বছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় যা বেড়েছে প্রায় ১৫০ শতাংশ!
এছাড়া, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলমকে নিয়ে একটি, ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীকে নিয়ে দুইটি, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলামকে নিয়ে একটি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে।
এর বাইরে, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে নিয়ে চারটি, বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে নিয়ে একটি, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যাব) নিয়ে দুইটি, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) নিয়ে তিনটি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার৷
নির্বাচন সামনে, জানান দিচ্ছে অপতথ্যের প্রবাহ
বাংলাদেশে বেশ জোরেশোরে নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। বিশেষ করে গত মাসে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাব্য একটি সময়ের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে জানানোর পর সংসদ নির্বাচনের ত্রয়োদশ সংস্করণ নিয়ে আলোচনা যেন এখন সর্বত্র। এই প্রেক্ষাপটে গত মাসেই রিউমর স্ক্যানার একটি গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, প্রথম পাঁচ মাসে দল হিসেবে বিএনপি সবচেয়ে বেশি অপতথ্যের শিকার হয়েছে। একই সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্তা-ব্যক্তিদের নামে ভুয়া এবং সম্পাদিত বক্তব্যের মাধ্যমে সিংহভাগ অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। এছাড়া, গণমাধ্যমের সম্পাদিত ও ভুয়া ফটোকার্ড ব্যবহার করে অপতথ্যের প্রচারও ছিল লক্ষ্যণীয়। সব মিলিয়ে গেল ছয় মাসে নির্বাচন সংক্রান্ত ৬৬টি অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৪২ শতাংশই জুন মাসে শনাক্ত হয়েছে। অর্থাৎ, নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ নিয়ে একটি ধারণা সামনে আসার পর এই ইস্যুতে অপতথ্য বাড়তে শুরু করেছে।
গত ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাসহ বিভিন্ন স্থানে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাতের সূত্রপাত হয়। এরপর হামলা, পাল্টা জবাব ও হুমকির মধ্যে ১২ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর যুদ্ধবিরতির খবর আসে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমসহ ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন ভুল তথ্য ছড়ায়, নিয়মিত প্রচার হয় পুরোনো ও ভিন্ন ঘটনার ভিডিও। ভুয়া ভিডিও তৈরিতে ব্যবহার হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তিও। এই ইস্যুতে ৭৬টি ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশ এবং বিদেশের একক কোনো ঘটনা প্রবাহে এটিই সর্বোচ্চ ভুল তথ্য শনাক্তের পরিমাণ। এসব ভুয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব ভুয়া তথ্যে আক্রমণকারী হিসেবে এবং প্রচারণা পক্ষে ছিল এমন ধরণে প্রায় ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই ইরানের নাম এসেছে। অন্যদিকে ধ্বংসাত্মক দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত ভুয়া ফুটেজের প্রায় ৭৩ শতাংশই ছিল ইসরায়েলের। ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস দাবির একাধিক ভিডিও এই সংঘাত চলাকালে প্রচার হলেও ইরানের সুনির্দিষ্ট নাম উল্লেখপূর্বক কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা সংক্রান্ত ফুটেজের দাবি পাওয়া যায়নি।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠকে তার পদত্যাগের ভাবনার কথা জানান। জানা যায়, এ সময় তিনি সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে নানা প্রতিবন্ধকতার কথা বলেন। এরই প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র এ বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। একইসাথে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে ভুয়া তথ্যের প্রবাহও লক্ষ্য করে রিউমর স্ক্যানার। ২২ থেকে ২৫ মে এই চারদিনে ড. ইউনূস পদত্যাগের গুঞ্জনকে ঘিরে অন্তত ১৬টি ভুয়া তথ্য শনাক্ত করে ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানার। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে একক কোনো ঘটনা প্রবাহে এটিই সর্বোচ্চ ভুল তথ্য শনাক্তের পরিমাণ।
দেশে চলতি বছর প্রথম ছয় মাসে সময়ে সময়ে এমন নানান ইস্যুতে সরগরম ছিল ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যম। এ সংক্রান্ত ৩৪টি ইস্যুতে ৩৯৩টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।
ভিইও থ্রি নিয়ে চিন্তা
প্রযুক্তির দিন দিন যেমন উন্নতি ঘটছে, তেমনি প্রসার ঘটছে এআই দিয়ে ভুয়া তথ্যের প্রচারেরও। সময়ের সাথে নিখুঁতভাবে ভুয়া ভিডিও বানিয়ে ফেলার বিষয়টি রপ্ত করে ফেলছে এআই প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তিতে সর্বশেষ আলোচনার জন্ম দিয়েছে গুগলের নতুন পরিষেবা ভিইও থ্রি (VEO 3)। এর মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে বাস্তব মনে হয় এমন ভিডিও তৈরি করা সম্ভব। এটি টেক্সট প্রম্পট থেকে বাস্তবসম্মত ভিডিও তৈরি করতে পারে। এই টুল দিয়ে তৈরি ভিডিওতে সাধারণত ‘Veo’ জলছাপ থাকে। গত মে মাসে গুগল এই পরিষেবাটি উন্মুক্ত করে। এর পরপরই এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ভুয়া ভিডিও বানিয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। গত মাসে এই প্রযুক্তি দিয়ে বানানো অন্তত আটটি ভুয়া ভিডিও শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।

সব মিলিয়ে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ১২৩টি ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে, যাতে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে। একই সময়ে ২২টি ডিপফেক ভিডিও শনাক্ত করা হয়েছে।
সাম্প্রদায়িক অপতথ্য ও ভারতীয় গণমাধ্যমের অপপ্রচারে লাগাম
সাম্প্রদায়িক অপতথ্য প্রচারের বিষয়টি গেল কিছু মাস ধরেই আলোচনায় রয়েছে। এ বছরের প্রথম প্রান্তিকে এমন ৭৮টি সাম্প্রদায়িক অপতথ্য শনাক্ত করে রিউমর স্ক্যানার। তবে পরের তিন মাসে তা প্রায় ৬৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। গেল ছয় মাসে শনাক্ত হওয়া ১০৬টি সাম্প্রদায়িক অপতথ্যের মধ্যে ৬৩টি ঘটনাতেই (৫৯ শতাংশ) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতীয় পরিচয়ধারী অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে প্রচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এছাড়া, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ সম্পর্কিত ২৫টি ঘটনায় ভারতের ৩১টি সংবাদমাধ্যমে ৩৮টি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি (৯) অপতথ্য প্রচারের দরুন এই তালিকায় সবার উপরে আছে আজতক বাংলা।

ফটোকার্ডের অপব্যবহার চলছেই
বিগত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে অপতথ্যের প্রচারে শক্তিশালী ও বহুল প্রচলিত মাধ্যম হয়ে উঠেছে গণমাধ্যমের ফটোকার্ড। এর সাথে গণমাধ্যমের নাম, লোগো এবং আনুষঙ্গিক উপাদান ব্যবহার করে নিয়মিতই অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে গণমাধ্যমের নাম, লোগো, শিরোনাম এবং নকল ও ভুয়া ফটোকার্ড ব্যবহার করে ৩০৮টি ঘটনায় দেশি ও বিদেশি ৬১টি সংবাদমাধ্যমকে জড়িয়ে ৩৩৩টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে ভুল তথ্য প্রচারে মূল ধারার গণমাধ্যম যমুনা টিভির নাম সবচেয়ে বেশি (৫১) ব্যবহার করা হয়েছে। এই তালিকার দ্বিতীয় স্থানে জনকণ্ঠ (২৬) এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে কালের কণ্ঠ (২৫)।
কাজের পদ্ধতি
এই পরিসংখ্যানটি রিউমর স্ক্যানারের ওয়েবসাইটে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর উপর ভিত্তি করে প্রকাশ করা হয়েছে। পরিসংখ্যান প্রকাশের নিমিত্তে নিয়মিত গত ছয় মাসের প্রতিটি প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে একটি নির্দিষ্ট ডাটাবেজের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এরপর তথ্য-উপাত্তগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এসব তথ্য-উপাত্ত তুলনা করা হয়েছে চলতি বছরের প্রথম দুই প্রান্তিক এবং গত বছরের প্রথম ছয় মাসের তথ্য উপাত্তের সাথে। পরবর্তীতে সেগুলোকে ইনফোগ্রাফিক এবং লেখার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে।
রাজনৈতিক এবং সরকারের বিভিন্ন কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে ছড়ানো ভুল তথ্যগুলো উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুইটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করে এই পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে। কোনো ভুল তথ্যের মাধ্যমে যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা দলের ইতিবাচক অবস্থান বোঝানোর চেষ্টা থাকে তাহলে সেই ভুল তথ্যকে ইতিবাচক এবং এর বিপরীতে কোনো ভুল তথ্যের মাধ্যমে যদি ব্যক্তি বা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে সেই ভুল তথ্যকে নেতিবাচক হিসেবে ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে ভুল তথ্য প্রচারের সময়, পরিস্থিতি এবং পারিপার্শ্বিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।